"লালবাগের কেল্লায় বেড়ানো" পুড়ান ঢাকা পর্ব-২
অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম লালবাগের কেল্লায় যাবো। ঢাকায় থাকি অথচ এখনো শায়েস্তা খানের কেল্লায় যাইনি! তা কি করে হয়?
গ্রুপ নিয়ে চলে গেলাম কেল্লায়।টিকেট কাউন্টারে গিয়ে ৫ টি টিকেট কিনলাম।জনপ্রতি ২০ টাকা।ভিতরে ঢুকেই দেখলাম পরীবিবির সমাধি।এই ভবনটি মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রিয় কন্যা পরীবিবির সমাধি নামে পরিচিত। বাংলাদেশে এই একটি মাত্র ইমারতে মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রং এর ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছে। কক্ষগুলির ছাদ কষ্টি পাথরে তৈরি। এ সমাধি সৌধটির ৪ কোনায় চারটি অষ্টকোনাকার বুরুজ রয়েছে। এসমস্ত বুরুজ নিচ থেকে উপরের দিকে সরু হয়ে উঠে গেছে এবং এর শীর্ষ বিভিন্ন প্যানেল দ্বারা অলংকৃত। বুরুজের শীর্ষদেশে গোলাকার কিউপোলা বা নিরেট ছাদ এবং চূড়া রয়েছে। দ্বিগম্বুজ বিশিষ্ট এই সমাধি সৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের কৃত্রিম গম্বুজটি তামার পাত দিয়ে আচ্ছাদিত। ২০.২ মিটার বর্গাকৃতির এই সমাধিটি ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের পুর্বে নির্মিত। তবে এখানে পরীবিবির মরদেহ বর্তমানে নেই বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আর এগিয়েই দেখলাম কেন্দ্রস্থলের দরবার হল ও হাম্মাম খানা।তারপর উত্তর পশ্চিমাংশের শাহী মসজিদ।মসজিদের এখনো নামাজ পড়া হয়।
ইতিহাসের পাতায় লালবাগ কেল্লার রূপকার হিসেবে শায়েস্তা খানের নাম পাওয়া গেলেও শায়েস্তা খান মূলত এই স্থাপনা নির্মাণকার্য শুরু করেননি। এটির নির্মাণের স্বপ্ন এবং সূচনা ঘটেছিল মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র মুহাম্মদ আযম শাহের হাত ধরে। আযম শাহ ১৬৭৮-৭৯ সাল পর্যন্ত মাত্র এক বছর বাংলার সুবাদার ছিলেন। এই সময়টাতে তিনি বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী স্থানে তার পিতার নামানুসারে একটি স্থাপনা নির্মাণের কাজে হাত দেন। যার প্রথম নাম আওরঙ্গবাদ কিল্লা হলে পরবর্তীকালে লালবাগ কেল্লা নামে পরিণত হয়ে যায়। সুবাদার আযম শাহ লালবাগ কেল্লা নির্মাণ শুরু করলেও দিল্লী থেকে জরুরি তলব আসায় ঢাকায় তিনি আর অবস্থান করতে পারেননি। তখন থমকে যায় লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কার্যটিও। তার অবর্তমানে ঢাকায় প্রেরিত নতুন সুবাদার শায়েস্তাখানকে তিনি আওরঙ্গবাদ কিল্লাটির অসম্পূর্ণ কার্য সম্পূর্ণ করার অনুরোধ করেন। শায়েস্তাখান আপন জামাতার এই নির্দেশনাকে বাস্তবায়ন করতে পারেননি তার বিশেষ পারিবারিক কারণে। এর পেছনে কয়েক ধরনের রটনা আছে। অনেকের মতে, এই আওরঙ্গবাদ কিল্লা বা লালবাগ কেল্লা নির্মাণের সময় শায়েস্তাখান তার কন্যা ইরান দুখতকে হারান। যিনি ছিলেন কেল্লা নির্মাণের প্রথম রূপকার আযম শাহের স্ত্রী। এ কারণেই শায়েস্তা খানের মনে বিশ্বাস জাগে কেল্লাটি একটি অপয়া স্থাপনা। সুতরাং তিনি অসম্পূর্ণ দুর্গটি নির্মাণে আর বেশিদূর অগ্রসর হননি। দুর্গ নির্মাণে শায়েস্তা খানের নিদারুণ অনাগ্রহ পর্যবেক্ষিত হলেও আপন কন্যা ইরান দুখতের মাজারকে তিনি দর্শনীয় স্থাপনা বানিয়ে তোলেন। মাজারটি নির্মাণের লক্ষ্যে শায়েস্তা খান ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাদা মার্বেল, ব্যাসল্ট, বেলে পাথরসহ আরও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ উপকরণ এনেছিলেন। আর এগুলোর সমন্বয়করণেই তৈরি হয়েছিল লালবাগ কেল্লার অন্যতম দর্শনীয় বিবি পরী বা ইরান দুখতের মাজারটি। এই মাজার ছাড়াও লালবাগ কেল্লার অভ্যন্তরে রয়েছে গোসলখানা, একটি মসজিদ, পুকুর আর বাগান। পুরো বাংলার শাসনক্ষমতা মোগল সম্রাটের অধীনস্থ থাকলেও সম্রাট আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খানের মেয়ের স্মৃতিস্বরূপ লালবাগ কেল্লাটিকে শায়েস্তাখানকে দান করে দেন। শায়েস্তাখানের পরবর্তী বংশধরেরা কেল্লাটিকে সরকারের কাছে লিজ দিয়ে বার্ষিক ৬০ টাকা করে পেতেন। পুরানা পল্টন থেকে ১৮৫৩ সালে সেনানিবাস পরিবর্তন করে এই লালবাগ কেল্লায় নিয়ে আসা হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের ক্ষেত্রেও এই কেল্লাটির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে কেল্লাটিকে একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এখতিয়ারে আছে। লালবাগ কেল্লায় প্রবেশ টিকিট মূল্য ২০ টাকা (বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য) ২০০ টাকা (বিদেশি নাগরিকদের জন্য)।
লালবাগ কেল্লার গ্রীষ্মকালীন (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) সময় সূচি হলো_ সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যস্ত। আর শীতকালীন (অক্টোবর থেকে মার্চ) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। মাঝে ১ টা থেকে ত্রিশ মিনিটের মাধ্যাহ্ন বিরতি। শুক্রবারে মধ্যাহ্ন বিরতি থাকে ১২টা ৩০ মিনিট থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। রোববার পূর্ণ দিবস, সোমবার অর্ধদিবস এবং সব সরকারি ছুটির দিনগুলোতে লালবাগ দুর্গ বন্ধ থাকে।
লালবাগ কেল্লার কিছু ছবি নিম্নে দেয়া হলঃ
ছবিগুলো তুলেছেনঃ আরশাদ খান পরশ ও ফরহাদ হোসেন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন